অনামিকা
১৬ই মার্চ,২০২০।স্কুল কোচিং শেষে বাড়ি ফিরছিলো অনু।মেজাজটা তার বড্ড খিটখিটে।কারণ স্কুলে অনেক হোমওয়ার্ক দিয়েছে।আজ তার ঘুম হবে না। বাড়ি গিয়ে খানিকক্ষণ রেস্ট নিলো।সন্ধ্যায় পড়তে বসলো।এমন সময় ঝিল্লির ফোন।ঝিল্লি, অনামিকার(অনুর) বেস্ট ফ্রেণ্ড।
—এই মরা,ফোন দিলি কেন?
—আরেহ দোস্ত,শুনিস নাই? কাল থেকে ৯ই এপ্রিল টানা ছুটি।
—সত্যি?
—টিভি জীবনে দেখিস তুই? আঙ্কেলকে বল বিক্রি করে দিতে।কেউ তো খবর রাখিস না।
—চুপ কর তো।দেখছি।
অনু খোঁজ খবর নিয়ে দেখলো কথা সত্য।মনটা নিমেষেই আহ্লাদে আটখানা।পড়াটা long time ধরে সহজে করা যাবে।করোনা ভালো কাজই করলো।হিহিহি
১৫ দিনে অনু পড়া শেষ করলো।অন্য পড়া করতে ইচ্ছে করছে না।চাপে না থাকলে পড়া হয় কি?৯ই এপ্রিল গেলো।ছুটি আরও বাড়ানো হলো।মে মাসের ১ তারিখ।অনুর আর ভালো লাগছে না।স্কুলে যেগুলোকে ও প্যারা মনে করতো, সেটাই সবথেকে ভালো মুহূর্ত ছিলো।সারাদিন বাসায় থেকে মেজাজটা খুব খিটখিটে হয়ে গেছে ওর।ওর ফ্রেণ্ডরাও একই পরিস্থিতিতে তাই ওদের সাথে ফোনে কথা বলে লাভ হচ্ছে না।সারাদিন মা-বাবা বাসায় বলে বন্ধুদের সাথে ঠিক করে কথা বলাও যায় না।সবাই কেমন জানি ছাড়া ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।অনু খুব মিস করে বন্ধুদের সাথে মারামারি,আড্ডা,টিফিন কেড়ে খাওয়া,বোরিং ক্লাসগুলোকেও মিস করে খুব। রিফ্রেশমেন্টের কোনো জায়গা ই নাই।
অনু খবরে দেখে ইতালি এখন প্রায় মৃত্যুপুরী।আসলে যে কি অবস্থা বোঝার মতো অনুভূতিই ওর হচ্ছে না।হঠাৎ একদিন অনুর মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন।জ্বর কমছেই না।কমে, বাড়ে।৪ দিনের মাথায় যোগ হলো শ্বাসকষ্ট। করোনা টেস্ট করে পজিটিভ এলো।অনু বিশ্বাসই করতে পারছে না।মায়ের কাছে যেতে পারছে না, শুধু শুনতে হচ্ছে বুকফাটা আর্তনাদ।অনু কিছুই বুঝতে পারছে না।কি করবে?অনুর মা আরও ১ দিন পর লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে।এ অবস্থা দেখে অনুর বাবা বাসায় অক্সিজেন সিলিণ্ডারের ব্যবস্থা করলেন।অনুর মা দুদিন একটু স্বাভাবিক কিন্তু তারপর আবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলো।শেষ পর্যন্ত হসপিটালে ভেন্টিলেশনে রাখা হলো।১২ দিনের মাথায় অনুর মা আর মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে পারলেন না।পরাজয় মেনে নিলেন।অনু আর ছোট মেয়ে তৃষাকে ছেড়ে ইহকাল আর পরকালের মধ্যবর্তী সেই মাটির নিচে আস্তানা খুঁজে নিলেন।
অনু এখনো বিষয়টা মেনে নিতে পারছে না।প্রতিটা নিঃশ্বাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা মায়ের অনুপস্থিতি কিভাবে মেনে নেওয়া যায়?শেষ দেখাটাও ঠিক করে দেখতে পারলো না সে।তবে ২ দিনেই জীবনের সবথেকে বড় একাকিত্বটা অনুভব করতে পারে অনামিকা।সকালে ঘুম থেকে উঠার জন্য কেউ বকে না,না খেলে কেউ খবর রাখে না,পড়তে বসতে ২ মিনিট পরপর কেউ বলে না,দিনশেষে আদর-স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া মানুষটার সত্ত্বা নেই আর।চোখের জলের মূল্য নেই।দুই বোনকে মানুষ করার স্বপ্নটা অপূর্ণ রেখেই চলে গেলো মা।দুবোনের টাকার অভাব হয়তো হবে না,কিন্তু স্নেহভরা সেই আঁচল শত সাধনাতেও পাবে না।
এমন হাজারো অনামিকা আছে আমাদের চারপাশে।২০২০ জীবনটা অন্ধকার করে দিয়ে গিয়েছে। আমরা যারা ভালো আছি, তারা আবার নতুন স্বপ্নে বুনতে চলেছি ২০২১।❤️