এক সংস্কৃতির সাথে অন্য সংস্কৃতির উপাদান বিনিময়ের ফলে সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে। আর বিভিন্ন সংস্কৃতির একসাথে সহাবস্থানের ফলে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রন ঘটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়, যা বাঙালি আর এসকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সমানভাবে পরিলক্ষিত।
ভাষাঃ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতির বহু উপাদান বাংলায় রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে 'দেশি শব্দ' নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ণয় করা যায় না,কিন্তু কোন ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মিলে। যেমন- কুড়ি(কোলভাষা), চুলা(মুন্ডারী ভাষা)। এরূপ- কুড়ি,গণ্ডা,পণ,হৈচৈ,গোলমাল,টা টি,কনকন,ঠনঠন ইত্যাদি। একইভাবে, বাংলা থেকেও প্রচুর শব্দ এসব ভাষায় প্রবেশ করেছে। ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, চাকমা ভাষা বাংলা, পালি, ওড়িয়া এবং অহমিয়া শব্দের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
জীবনযাত্রার উপকরণঃ বিভিন কৃষি উপকরণ, যেমন- লাঙ্গল,জোয়াল,ঢেঁকি,কুলা,মই,কাস্তে ইত্যাদি, মাছ ধরার উপকরণ, যেমন-পলো,ডুলা,কোঁচ,চাই,বড়শি এবং নৌকা চালানোর উপকরণ, যেমন-পাল,দাঁড়,লগি,বৈঠা,বাতা ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি থেকে এসেছে।
উৎসবঃ নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য করার পালিত পার্বত্য চটগ্রামের বৈসাবি আর বিজু আজ বাঙালির পহেলা বৈশাখের সাথে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। নতুন ধান মাড়াইয়ের বাঙালির নবান্ন আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ওয়ানগালা আজ একই সূত্রে গ্রোথিত।
পোশাকঃ বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদের পাশাপাশি বাঙালিদের পোশাক-পরিচ্ছদও ব্যবহার করছে,
বিনোদনের মাধ্যমঃ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মণিপুরিদের নাচ বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাছাড়া সাঁওতালদের ঝুমুর নাচ,চাকমাদের বাঁশ নৃত্য আর ত্রিপুরাদের বোতল নাচও বেশ জনপ্রিয়। অপরদিকে বাঙালি সংস্কৃতির নাচ-গানও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
খাদ্যাভ্যাসঃ শৌখিন বাঙালির পাতে আজ মাছ-ভাতের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের তৈরি বাঁশের রান্নার বিভিন্ন পদ। একইসাথে তারাও অভ্যস্ত হয়েছে বাঙালি রান্নায়।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের অবদান অবিস্মরণীয়। যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ও বাঙালিদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও আদান-প্রদানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধে চাকমা,মারমা,সাঁওতাল,ওঁরাও,মালপাহাড়ি,গারো,ত্রিপুরা,মং,রাখাইন ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষ পাকিস্তানি হানাদারগুলোর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং শহিদ হয়েছিল।
বাংলাদেশের ভূখন্ডে সাধারণ বাঙালির পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে। আমাদের বাঙালিদের যেরকম নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রয়েছে, ঠিক তেমনইভাবে তাদেরও আছে নিজ নিজ সংস্কৃতি, নিজ নিজ কৃষ্টি-কালচার। ফলে উভয় সংস্কৃতির উপাদানের বিনিময়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটেছে, যা সাংস্কৃতিক আন্তঃসম্পর্কের ভিত রচনা করেছে। এই আন্তঃসম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ এবং স্থায়ী হবে ততই উভয় সংস্কৃতির মধ্যে সুষম যোগাযোগ স্থাপিত করবে, যা বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
সুতরাং, পরিশেষে বলা যায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাথে বাঙালির সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণই বাংলাদেশকে একটি বহুসংস্কৃতির দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে।