যে প্রক্রিয়ায় শিশুর সামাজিক মানুষের পরিণত হয় তাকে সামাজিকীকরণ বলে। জন্মের পর মানব শিশু প্রথমে মায়ের এবং পরবর্তী সময়ে অন্য সদস্যদের সংস্পর্শে আসে। পরিবারের সকল সদস্যের আচরণ শিশুর আচরণকে প্রভাবিত করে। এভাবে শিশু পরিবারের বাইরের পরিবেশ, যেমন- খেলার সাথী, পাড়া-প্রতিবেশী, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। শিশু যে সমাজে বড় হচ্ছে সে সমাজের প্রথা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে শেখে এবং সামাজিক মানুষের পরিণত হয়। জন্মের পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সুতরাং সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি যখন একপর্যায়ে হতে আর এক পর্যায়ে প্রবেশ করে তখন তাকে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে তার আচরণে পরিবর্তন আসে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আমাদের সামাজিকীকরণকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে যার অধিকাংশই নেতিবাচক। যেমন-
-
বিদ্যালয় শিশুর সামাজিকীকরণ এর আনুষ্ঠানিক মাধ্যম। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শিশুরা কতগুলো সামাজিক আদর্শ বিদ্যালয় থেকে শিখে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা, পারস্পরিক ভালোবাসা প্রভৃতি। শিশু বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মচারী, বিদ্যালয়ের পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ প্রভৃতির সংস্পর্শে আসে। এসব উপাদান শিশুর আচরণকে প্রভাবিত করে। শিশুর মনে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, দেশপ্রেম, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতিবোধ প্রভৃতি জাগ্রত হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এগুলো আয়ত্তের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
-
শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণে খেলা ও পড়ার সঙ্গী-সাথীরা ভূমিকা রয়েছে। এদের মাধ্যমেই সহযোগিতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও নেতৃত্ব প্রভৃতি গুণাবলী বিকশিত হয়। এই সঙ্গী-সাথীর মধ্যে কখনো কখনো সমস্যা বা দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর মধ্য দিয়ে শিশুরা সমস্যার সমাধান ও দ্বন্দ্ব নিরসন কৌশল আয়ত্ত করে। খেলা ও পড়ার সঙ্গী-সাথীদের মাধ্যমে শিশু নিজের আচরণের ভালো-মন্দ দিকের প্রশংসা বা সমালোচনা শুনতে পায়। এ ধরনের সমালোচনা থেকে শিশু সমাজের কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিশু-কিশোররা তাদের সঙ্গী সাথীদের সাথে মিশতে পারছে না। এতে তাদের সুষ্ঠু ও সাভাবিক সামাজিকীকরণে ব্যাঘাত ঘটছে।
-
এছাড়া সামাজিকীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হলো জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও পাড়া-প্রতিবেশি। নিজ পরিবার ব্যতীত যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে তারাই আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। যারা বাড়ির আশেপাশে বসবাস করেন তারা হলো আমাদের প্রতিবেশী। শৈশব থেকেই ব্যক্তি গোষ্ঠী ও প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে বড় হতে থাকে। পরিবারের পরেই জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবেশীদের অবস্থান। আমাদের পাশাপাশি বাড়িগুলোতে সম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতিবেশী দল গড়ে ওঠে। প্রতিবেশী দল থেকে শিশু সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও নেতৃত্ব প্রভৃতি গুণাবলী অর্জন করে। প্রতিবেশীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে জন্মদিন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে এবং সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, সম্প্রীতি প্রভৃতি গুণাবলি অর্জন করে। প্রতিবেশীর যে কোন অনুষ্ঠানে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করে, যেমন- জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী প্রভৃতি। আবার কেউ অসুস্থ হলে নিকটাত্মীয় চেয়ে প্রতি বেশি বেশি ভূমিকা পালন করে প্রতিবেশী সুখ-দুঃখের প্রথম অংশীদার। কিন্তু বর্তমানে কোভিড লকডাউনের কারণে মানুষের পারস্পরিক সামাজিক যোগাযোগ ও হৃদ্যতা কমে আসছে।
-
আর বর্তমানে চারিদিকে যে বিভীষিকা চলছে তা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনে গভীর দাগ কাটছে। প্রতিদিনই রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজে করোনার ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে তারা মানসিক চাপে ভুগছে। এছাড়াও প্রতিদিন করোনায় মৃত্যুর খবর তাদের মনে ভীতির সৃষ্টি করছে। এতে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটছে।
কোভিড-১৯ সামাজিকীকরণে যে নেতিবাচক প্রভাবগুলো ফেলছে সেগুলোকে ইতিবাচকভাবেও গ্রহণ করা সম্ভব। যেমন-
-
করোনার কারণে বর্তমানে মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসচেতনতার ব্যাপারে অনেক সতর্ক হয়েছে।
-
মহামারীতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অধিকাংশ স্কুল-কলেজ ক্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। এতে শিশু-কিশোররা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করছে। আর শিক্ষক ও বন্ধুদের সাথে ভার্চুয়ালি দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।
-
করোনা থেকে পরিত্রাণের জন্য সবাই একসাথে চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
-
করোনার বিভীষিকার কারণে শিশু-কিশোররা বাস্তববাদী হয়ে উঠছে এবং প্রতিকূলতা মোকাবেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করছে।