প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, গিরগিটি কখনোই তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য রঙ পরিবর্তন করে না!! এটি স্রেফ একটি মিথ বা ভুল ধারণা ছাড়া কিছুই নয়!
ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত অ্যানিমেশন ফিল্ম "Tangled" এ এমনটা দেখানো হয়েছিল যে, গিরগিটি যেখানেই যায়, সে অনুযায়ী রঙ নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলে। অনেকটা একটা গিরগিটিকে যদি দাবার বোর্ডে রাখা হয়, তবে তার মধ্যে ওরকম সাদা-কালো ডিজাইন ফুটে উঠবে। কিন্তু এই বিষয়টি ভুল। গিরগিটি তার আশেপাশের পরিবেশ অনুযায়ী রঙ পরিবর্তন করতে পারে না।
এখন আমার এই কড়া উত্তর শুনে হয়তো অনেকেই প্রমাণস্বরূপ নিচের ছবিগুলোর মতন একগাদা ছবি দেখিয়ে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করবে, " যদি গিরগিটি এমনটা না-ই করতে পারে, তবে এসব কী??"
ঠিকই তো! যদি গিরগিটি আসলেই পরিবেশ অনুযায়ী রঙ পরিবর্তন না করতে পারে তবে এসব কী?এসব ছবি তো একেবারে আমার কথার বিরুদ্ধে সাক্ষাৎ দলিল হয়ে গেলো! কিন্তু আসলেই কী তা-ই?
না। চলে যাই সেই দাবার বোর্ডে থাকা গিরগিটির কাছে। গিরগিটি দাবার বোর্ডের মতন রঙ ধারণ করতে পারবে না সত্যি, কিন্তু যদি এমন হয় গিরগিটিটির রঙ "জন্মগতভাবেই" দাবার বোর্ডের মতন,তবে? তখন অবশ্যই তাকে আর আলাদা করে শনাক্ত করা যাবে না। বিষয়টি আবার লক্ষ করুন, পরিবেশ অনুযায়ী এই রঙ বদল কিন্তু তার ইচ্ছানুযায়ী হঠাৎ করে হয় নি, বরং জন্মগতভাবে তার রঙই এরকম। যার অর্থ দাঁড়ায়, গিরগিটির রঙ এমনিতেই তার বাসস্থান অনুযায়ী, যেমনটা উপরের ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে। আর এর পেছনে আছে হাজার বছরের বিবর্তন।
এক কথায় বললে, গিরগিটির রঙ বিবর্তনের কারণে জন্মগতভাবেই তার বাস্তুতন্ত্র বা বায়োমের সাথে মিলানো। আর পেছনের কারণটাও খুব সোজা, শিকারীর কাছ থেকে আত্মরক্ষা। কেননা ধীরগতির নিরীহ এই প্রাণীদের আত্মরক্ষার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। এই বিশেষ কৌশলটিকে বলা হয় Camouflage , যা গিরগিটি ছাড়াও আরও অনেক প্রাণীর জন্যও খাটে।
এখন হয়তো আমাদের প্রশ্নকর্তা বন্ধু হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করবেন, গিরগিটির রঙ পরিবর্তন বিষয়টা কী তাইলে একবারে মিথ্যা একটি জিনিস?
কিন্তু এর চমকপ্রদ উত্তরটি হচ্ছে, গিরগিটি রঙ পরিবর্তন করতে পারে!! গিরগিটি তার দেহের তাপমাত্রা,যোগাযোগ এবং "আবেগ-অনুভূতি" প্রকাশের জন্য তার রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম।
বিষয়টি বোঝার জন্য জনপ্রিয় panther chameleon এর কাছে যেতে হবে।
ধরি, এই পুরুষ গিরগিটিটি একদুপুর বেলা গাছের ডালে বসে ঘুমানোর ট্রাই করছিলো। এমন সময় হঠাৎ করে সে তার ক্রাশ স্ত্রী গিরগিটিকে পাশের ডালে বসে দেখতে পেলো।
এখন, তার জায়গায় কোনো মানুষ থাকলে অবশ্যই বেচারা লজ্জায় লালই হয়ে যেত! এদিক দিয়ে গিরগিটিও খুব বেশি একটা নয়। এই লাজুক গিরগিটির কালো-সবুজ রঙ লজ্জা আর উত্তেজনার কারণে একেবারে উজ্জ্বল হলুদ-লাল হয়ে যাবে।
এখন প্রশ্ন ,কীভাবে এই লাজুক গিরগিটি লজ্জায় একেবারে গায়ের রঙ বদলে ফেললো? তার উত্তর আছে গিরগিটির ত্বকের গঠনে।
গিরগিটির ত্বকে বিভিন্ন রঙিন পিগমেন্টযুক্ত বিশেষ কোষ আছে। এই কোষগুলোতে থাকা পিগমেন্টগুলো তিনরকম হতে পারে- হলুদ পিগমেন্ট, লাল পিগমেন্ট এবং গাঢ় মেলানিন পিগমেন্ট।
এই গাঢ় মেলানিন পিগমেন্টগুলো কোষের আঙ্গুলের মতো অংশগুলোতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, যার জন্য এদের রঙ গাঢ় হতে পারে। আবার এই পিগমেন্টগুলো শোষণ করে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিলে এদের রঙ আগের মতন হালকা হয়ে যায়।
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এই একই ঘটনা কিন্তু অন্য দুটি পিগমেন্টের ক্ষেত্রে ঘটে না। যদি ঘটতো তবে সবুজ রঙ পাওয়া যেতো না। কারণ সবুজ রঙ হলুদ-নীল মিলে হয়, হলুদ-লালে না।
কিন্তু ভারি সমস্যা! এদের গায়ে তো কোনো নীল পিগমেন্টই নেই!
এমন সময় দেখা গেলো গিরগিটির গায়ে শুধু পিগমেন্টই নয়, এক বিশেষ ধরণের ন্যানোক্রিষ্টালওআছে!! এই ন্যানোক্রিষ্টালগুলোর অবস্থান হলুদ ও লাল পিগমেন্টের একেবারে নিচে।
এই ন্যানোক্রিষ্টালগুলো একধরনের বিশেষ ধরনের আয়নার মতো কাজ করে। এরা শুধু নীল আলো প্রতিফলন করে। ফলে হলুদ পিগমেন্টের হলুদ এবং এই ক্রিষ্টাল থেকে প্রতিফলিত নীল আলো- দুটি মিলে গিরগিটির সবুজ রঙ তৈরি করে, যেটি আমরা সাধারণত দেখতে পাই।
এখন আসি সবচেয়ে চমৎকার অংশটুকুতে। গিরগিটির ত্বকে থাকা এই ছোট ক্রিষ্টালগুলোর বিন্যাস তাদের অনূভুতি উত্তেজনা দিয়ে পরিবর্তিত হয়। ফলে এই ক্রিষ্টালগুলোর মাঝের ফাকা স্থান কখনো বাড়ে, আবার কখনোবা কমে।
যখন এই ফাকা স্থান বাড়ে, তখন বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (লাল ও হলুদ) প্রতিফলিত হয়। আবার যখন এই ফাকা স্থান কমে, তখন কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ( সবুজ ও নীল) প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ, ক্রিষ্টালের এই বিন্যাসের পরিবর্তনের ফলেই গিরগিটির রঙ পরিবর্তিত হয়।
সোজা ভাষায় বললে, ভয়ে যেমন আমাদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, সেরকম লজ্জায় গিরগিটির গায়ে থাকা ক্রিষ্টালের বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে তার গায়ের রঙের পরিবর্তন ঘটে।
এই প্রশ্নের অধিকাংশ ছবিই এই ভিডিও থেকে ধার করা।
তাছাড়া প্লেজারিজমের জন্য আবার যাতে ফেসে না যাই, তার জন্যে বাকি ছবিগুলোর সূত্রও দিয়ে দিলাম।